জিহাদ বনাম সন্ত্রাসবাদ: ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিকোণ



জিহাদ—শব্দটির আভিধানিক অর্থ অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। এটি আরবি শব্দ ‘জাহাদা’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো প্রচেষ্টা চালানো, কঠোর সাধনা করা এবং নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। জিহাদ শব্দটি কেবল যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত নয়; বরং এটি একটি ব্যাপকতর ধারণা, যা আত্মোন্নয়ন থেকে শুরু করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মতো নানা কর্মকাণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে।

আরবি ভাষায় জিহাদ শব্দের বিভিন্ন শাব্দিক অর্থ পাওয়া যায়, যেমন:
১. আল জাদ্দু (اَلْجَدُّ)—প্রচেষ্টা করা।
২. আত্ব ত্বা-কাতু (اَلطَّاقَةُ)—কঠোর সাধনা করা।
৩. আস্ সা’ইউ (اَلسَّعْيُ)—চেষ্টা করা।
৪. আল মুশাক্কাতু (اَلْمُشَقَّةُ)—কষ্ট বহন করা।
৫. বাযলুল ক্যুওয়াহ (بَذْلُ القُوَّةِ)—শক্তি ব্যয় করা।

এই ব্যাখ্যাগুলি থেকে স্পষ্ট হয়, জিহাদ মানে শুধু শারীরিক যুদ্ধ নয়; বরং এটি মানসিক, আত্মিক এবং শারীরিক প্রচেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত একটি পবিত্র সংগ্রাম।

জিহাদ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ইসলামী শরিয়াহ অনুসারে জিহাদের প্রকৃত অর্থ হলো—আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জীবন, সম্পদ এবং সামর্থ্য দিয়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো। হানাফি মাযহাবের প্রসিদ্ধ আইনগ্রন্থ ‘বাদাউস সানায়ী’-এ বলা হয়েছে:

> “জিহাদ হলো নফস, সম্পদ এবং জীবনের মাধ্যমে সর্বাত্মক চেষ্টা ও শক্তি প্রয়োগ করা।”



আরেকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘শরহুল ওয়াকায়া’-তে উল্লেখ করা হয়েছে:

> “জিহাদ হলো সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান জানানো এবং যারা তা অস্বীকার করে, তাদের প্রতিরোধ করা।”



জিহাদ বনাম সন্ত্রাসবাদ

জিহাদ কখনোই সন্ত্রাসবাদের সমার্থক নয়। ইসলামে জিহাদ একটি পবিত্র ও নির্ধারিত পন্থায় সংঘটিত হয়, যা আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এবং মানুষের কল্যাণে পরিচালিত। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ হলো একটি অপবিত্র ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, যা ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা এবং সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

ইসলাম সন্ত্রাসবাদের কঠোর বিরোধিতা করে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:

> “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।” (সূরা আল-মায়িদা: ৫:৩২)



এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে কখনোই সমর্থন করে না।

সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি ও এর প্রভাব

সন্ত্রাসবাদ সাধারণত রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির একটি হাতিয়ার। এটি সমাজে বিভ্রান্তি, ভীতি এবং ধ্বংস সৃষ্টি করে। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করা এবং আতঙ্ক ছড়ানো—এসবই সন্ত্রাসবাদের বৈশিষ্ট্য।

কিছু দুঃখজনক ঘটনার কারণে কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে জিহাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করে সন্ত্রাসকে জিহাদের নামে উপস্থাপন করছে। এটি ইসলামের প্রতি অন্যায় এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবতার গুরুত্ব

ইসলাম ধর্মে প্রতিটি মানুষের জীবন, সম্পদ এবং মর্যাদা পবিত্র। রাসূল (সা.) বলেছেন:

> “যে ব্যক্তি কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।”



এমনকি যুদ্ধকালীন সময়েও ইসলামে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং নিরপরাধ মানুষদের আঘাত না করার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি সন্ত্রাসবাদ এবং ইসলামী জিহাদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে।

উপসংহার: জিহাদ বনাম সন্ত্রাসবাদ

জিহাদ হলো আল্লাহর রাস্তায় সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, যা মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদ হলো একটি ধ্বংসাত্মক ও অনৈতিক কাজ, যা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনীতির নামে পরিচালিত হয়।

সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে জিহাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝানো এবং প্রচার করা মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব। ইসলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, এবং প্রকৃত জিহাদই শান্তি, ন্যায় এবং মানবতার পক্ষে।

| জনপ্রিয় আর্টিকেল

| সাম্প্রতিক আর্টিকেল

A Living Example of Human Perfection:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাঁকে এমন মহান চরিত্র দান করেছিলেন, যার সমকক্ষ আর কেউ

স্মৃতির টান

        আমি আজ এক দূর দেশে আছি। চারপাশে উঁচু উঁচু দালান, কংক্রিটের দেয়াল, হাওয়ায় গাড়ির ধোঁয়া আর যন্ত্রের শব্দ। এখানে

প্রাকৃতির সৌন্দর্য

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগোতে থাকি, তখন চারপাশ যেন একেবারে নতুন এক জগত খুলে দেয়। ডানদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে

| ক্যাটাগরি

Scroll to Top