আমি আজ এক দূর দেশে আছি। চারপাশে উঁচু উঁচু দালান, কংক্রিটের দেয়াল, হাওয়ায় গাড়ির ধোঁয়া আর যন্ত্রের শব্দ। এখানে জীবন চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে, কেউ কারও দিকে তাকানোরও সময় পায় না। কিন্তু এর মাঝেই আমার হৃদয়ের কোণে এক মধুর কষ্ট নাড়া দেয়—সেটা আমার শৈশবের গ্রাম, আমার মাটির ঘর, আমার মা, আমার খেলার সাথী আর সেই সবুজ শ্যামল মায়াময় প্রকৃতি।
মনে পড়ে ভোরবেলা ঘুম ভাঙার আগেই পাখির ডাক কানে আসত। শালিক, দোয়েল, কাক—সব মিলিয়ে গ্রাম যেন এক সুরেলা সঙ্গীতের দেশে রূপ নিত। শীতের কুয়াশা ঢেকে দিত পুরো মাঠ, তখন মায়ের ডাক ভেসে আসত—“ওরে, ঘুম থেকে ওঠ! ভোর হয়েছে।” সেই ডাকের মধ্যে ছিল আদর, ছিল ভালোবাসার ছোঁয়া, যা শহরের যান্ত্রিক অ্যালার্মে কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায় না।
গ্রামের আঁকাবাঁকা নদীটাও যেন আজও আমাকে ডাকে। গরমের দুপুরে সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম নদীতে, সাঁতার কাটতে কাটতে কখন যে সূর্য ঢলে পড়ত টেরই পেতাম না। বর্ষাকালে নদীর বুকে কচুরিপানার ভেলা বানিয়ে কত দূর ভেসে যেতাম—সেই আনন্দ ভাষায় বোঝানো যায় না। আজ সেই নদী আমার কাছে শুধু স্মৃতি, কিন্তু সেই স্মৃতিই আমার বুক ভরে দেয় অদ্ভুত শান্তিতে আর কষ্টে।
মায়ের হাতের রান্নার কথা মনে হলে মনটা আরও অস্থির হয়ে ওঠে। ভাত, ডাল, শাকভাজা আর কাঁচা মরিচ—শুধু এগুলো দিয়েই যে কত সুখে খেয়েছি! শহরের শত রকম খাবারের মাঝেও মায়ের হাতের এক চামচ ভাতের স্বাদ খুঁজে পাই না। মায়ের হাতের গন্ধ, মায়ের স্নেহ মিশ্রিত আহার—এটাই ছিল জীবনের আসল সুখ।
খেলার সাথীদের কথাও খুব মনে পড়ে। বিকেলের সময় মাঠ ভরে উঠত হাসি-খুশিতে। দৌড়ঝাঁপ, লুকোচুরি, পলাপানি খেলা—সব কিছুতেই ছিল এক অপরিসীম আনন্দ। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল কৃত্রিম খেলা, ছিল শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্য আর মন ভরানো বন্ধুত্ব।
ভোরের কুয়াশা ঢাকা মাঠে গরুর গাড়ির ঘন্টা, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া—সব মিলিয়ে সেই গ্রামীণ পরিবেশ যেন এক পরিপূর্ণ কবিতা। এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি যেন দেখতে পাই সেই দৃশ্য, অনুভব করতে পারি সেই হাওয়ার ছোঁয়া।
আজ আমি হাজার মাইল দূরে থেকেও বুঝতে পারি, মানুষ যত বড়ই হোক, যত উন্নত জীবনই পাক, শেকড় তাকে টানবেই। আমার শেকড় সেই গ্রামে—যেখানে মা আছেন, যেখানে সবুজ মাঠ আছে, যেখানে নদী আছে, যেখানে আমার শৈশবের হাসি-কান্না মিশে আছে।
হৃদয়টা বারবার বলে ওঠে—যদি একবার ছুটে যেতে পারতাম! আবার মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে শান্তি পেতাম, আবার গ্রামের মাঠে দৌড়ে বেড়াতাম, আবার সেই নদীর শীতল জলে সাঁতার কাটতাম।
গ্রাম আমার কাছে শুধু স্মৃতি নয়—এটা আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যত দূরেই থাকি, যত বিদেশেই থাকি, গ্রামকে আমি ভুলতে পারব না। একদিন আমি আবার ফিরব—সেই মাটির ঘরে, সেই আঁকাবাঁকা নদীর তীরে, সেই সবুজ শ্যামল জনপদে। আর মায়ের হাতের ভাত খেয়ে চোখ ভরে কান্না আর আনন্দে মিলিয়ে যাবে সব অভিমান।
